পায়রাবন্দ: বেগম রোকেয়ার স্মৃতিধন্য গ্রাম

পায়রাবন্দ: বেগম রোকেয়ার স্মৃতিধন্য গ্রাম

পায়রাবন্দ: বেগম রোকেয়ার স্মৃতিধন্য গ্রাম

রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার একটি ঐতিহাসিক গ্রাম পায়রাবন্দ। এই গ্রামটি মূলত বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন, যা বাঙালি সমাজে নারীশিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) ছিলেন একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী হিসেবে পরিচিত। তাঁর জীবন ও কর্ম নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

সংক্ষিপ্ত জীবন

  • জন্ম: ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
  • শিক্ষা: তৎকালীন সমাজে মেয়েদের শিক্ষা প্রায় নিষিদ্ধ থাকলেও, তিনি নিজের প্রচেষ্টায় ভাই ইব্রাহীম সাবেরের সহায়তায় বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষা শেখেন।
  • বিবাহ: ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর স্বামী মুক্তমনা ছিলেন এবং তাঁকে লেখালেখিতে উৎসাহ দিতেন।
  • মৃত্যু: ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন।

উল্লেখযোগ্য কর্ম ও অবদান

১. নারী শিক্ষায় অবদান

  • বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: ১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি নারীশিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। স্বামীর দেওয়া অর্থে তিনি ভাগলপুরে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে পারিবারিক কারণে ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে ১৯১১ সালে আটজন ছাত্রী নিয়ে নতুন করে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই স্কুল ক্রমান্বয়ে মধ্য ইংরেজি গার্লস স্কুল এবং উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে রূপান্তরিত হয়।
  • শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রচার: তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নারীর অধিকার ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির পূর্বশর্ত হলো সুশিক্ষা। তিনি তাঁর লেখায় ও বক্তৃতায় নারী শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন এবং মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে সমাজের সঙ্গে লড়াই করেছেন।
  • পাঠক্রম ও পদ্ধতি: রোকেয়া প্রকৃতি ও বস্তু পাঠ এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রায়োগিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল নারীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার বিকাশ।

২. সমাজ সংস্কারে অবদান

  • আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম: ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ (মুসলিম মহিলা সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন। নিরক্ষর ও দরিদ্র নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে এই সমিতি বহুমুখী কাজ করত। এই সমিতির মাধ্যমে তিনি নারীদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিলেন।
  • কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে: তিনি তাঁর লেখনীতে সমাজের কুসংস্কার, বিশেষ করে অবরোধ প্রথার কুফল এবং নারীর প্রতি সামাজিক অনাচার ও অপমানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও তাঁর লেখনী ছিল সোচ্চার।
  • ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা: তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের অবদমিত করার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন এবং কোরআন শরীফকে মূল অর্থসহ পাঠ করার কথা বলেন, যা নারীর অধিকারের পক্ষে ইসলামী বিধানের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে।
  • নারী অধিকার সচেতনতা: তিনি নারীদের নিজেদের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে এবং নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন হতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সমাজ অর্ধেক নারী অংশকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়।

৩. সাহিত্য কর্ম

বেগম রোকেয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক। তাঁর লেখায় উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা ফুটে উঠেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হলো:

  • মতিচূর (প্রবন্ধ): এটি প্রবন্ধ সংকলন।
  • সুলতানার স্বপ্ন (Sultana’s Dream): এটি একটি নারীবাদী ইউটোপিয়ান নকশাধর্মী রচনা এবং বিশ্ব নারীবাদী সাহিত্যের একটি ক্লাসিক নিদর্শন। ১৯০৫ সালে এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।
  • পদ্মরাগ (উপন্যাস): এটি তাঁর রচিত অন্যতম একটি উপন্যাস।
  • অবরোধবাসিনী (নকশাধর্মী গদ্যগ্রন্থ): এই গ্রন্থে তিনি অবরোধ প্রথার কুফলকে ব্যঙ্গ করেছেন।
  • পিপাসা (গল্প): ১৯০২ সালে এটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘নভপ্রভা’ পত্রিকায় ছাপা হয়, যা তাঁর সাহিত্য জগতে প্রবেশের সূচনা।

বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র

বেগম রোকেয়ার পৈতৃক বাড়ির পাশেই তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩.১৫ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। এখানে রয়েছে নান্দনিক বাগান, একটি আধুনিক অফিস ভবন, চারতলা ডরমেটরি, গবেষণা কক্ষ, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, আধুনিক গেস্ট হাউজ এবং বেগম রোকেয়ার একটি পিতলের ভাস্কর্য। এছাড়াও, স্মৃতিকেন্দ্রের অভ্যন্তরে বিকেএমই (BKME) নামের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে তরুণদের কর্মসংস্থানে সহায়ক বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দুঃখজনকভাবে, বেগম রোকেয়ার পৈতৃক বাড়িতে এখন শুধু ইটের দেয়ালের গাথুনি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, যা তাঁর স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাসকে মূর্ত করে তোলে।

কিভাবে যাবেন পায়রাবন্দ?

পায়রাবন্দ গ্রামটি রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

ঢাকা থেকে রংপুর:

  • বাসে: ঢাকার মোহাম্মদপুর, মহাখালী, গাবতলী এবং কল্যাণপুর থেকে নাবিল, হক এন্টারপ্রাইজ, এস আর ট্রাভেলস, আগমনী এক্সপ্রেস, এনা, হানিফ, গ্রিনলাইন, আলহামরা ট্র্যাভেলস, মীম, এস আর ট্র্যাভেলস, কুড়িগ্রাম পরিবহনের মতো অসংখ্য বাস সার্ভিস রংপুরের উদ্দেশ্যে চলাচল করে। এসি ও নন-এসি উভয় ধরনের বাস পাওয়া যায়, যার ভাড়া ৭৫০-১৫০০ টাকা।
  • ট্রেনে: ঢাকার কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে রংপুর এক্সপ্রেস ও কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনেও রংপুর যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে শোভন চেয়ারের টিকিট ৫৮৫-৬৩৫ টাকা, স্নিগ্ধা ১১২২-১২১৪ টাকা, এসি সিট ১৪৫৫ টাকা এবং এসি বার্থের টিকিট ২০১৩ টাকা।

রংপুর শহর থেকে পায়রাবন্দ:

রংপুর শহরে পৌঁছে রিকশা, ইজিবাইক অথবা স্থানীয় বাসে চড়ে সহজেই পায়রাবন্দ গ্রামে পৌঁছানো যায়।

আবাসন ও খাবারের ব্যবস্থা

কোথায় থাকবেন:

রংপুরে রাত্রিযাপনের জন্য বেশ কিছু ভালো মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে হোটেল নর্থভিউ, পর্যটন মোটেল, দি পার্ক হোটেল, হোটেল গোল্ডেন টাওয়ার, হোটেল তিলোত্তমা, এবং হোটেল কাশপিয়া উল্লেখযোগ্য।

কোথায় খাবেন:

রংপুর শহরে বিভিন্ন ধরনের খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আছে, যেখানে স্থানীয় এবং প্রচলিত সব ধরনের খাবার পাওয়া যায়। যদি আমের মৌসুমে (সাধারণত জুন-জুলাই) রংপুর ভ্রমণ করেন, তবে অবশ্যই রংপুরের বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আম খেয়ে দেখবেন।

পায়রাবন্দ গ্রামটি শুধুমাত্র বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান হিসেবেই নয়, তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবেও পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়।

Comments

Popular posts from this blog

Benefits and Side Effects of Eating Grapes

আমলকীর পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা

Education is the spine of nation

Saturn is the cosmetic beauty of universe

Breaking the Chains: How Terrorism Holds Humanity Back

Fake huminity and democracy

Benefits and Side Effects of Eating Pomegranate

Mysterious performance of exoplanets ,kepler 186f and kepler 452b planets

The beauty of birds miracle of the natural world