ফাতরার চর: প্রকৃতির এক লুকানো রত্ন, দ্বিতীয় সুন্দরবন
সুন্দরবনের বর্ধিত অংশ ফাতরার চর (Fatrar Char), কুয়াকাটার পশ্চিমে প্রায় ৯,৯৭,৫০৭ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এক প্রাকৃতিক বিস্ময়। একে "দ্বিতীয় সুন্দরবন" বলা হয় এর অসাধারণ ম্যানগ্রোভ বন এবং জীববৈচিত্র্যের কারণে। ফাতরার চর তার অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বন্যপ্রাণীর সমারোহ নিয়ে পর্যটকদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
---ফাতরার চরের মন্ত্রমুগ্ধকর প্রকৃতি
ফাতরার চরে ঢুকলেই আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে গেওয়া, সুন্দরী, কেওড়া, ফাতরা, গরান, গোলপাতা, বাইন সহ নানা প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছের ঘন সবুজ বন দেখে। এই সবুজ অরণ্য মনকে প্রশান্তি এনে দেয়। গাছের ডালে দেখা মেলে বানর, বনের গভীরে শূকর, আর আকাশে ওড়ে নানা রঙের পাখি। এছাড়াও, সাপ ও গুইসাপের মতো কিছু সরীসৃপও এই চরের বাস্তুতন্ত্রের অংশ। সুন্দরবনের মতোই ফাতরার চরও দিনে দুবার জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয়, যা এখানকার পরিবেশকে আরও গতিময় করে তোলে।
ফাতরার চরের খালে ট্রলারে প্রবেশ করা মাত্রই দু'পাশের ঘন সবুজ অরণ্য আপনাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যাবে। চরের ভেতরে ঢুকলে প্রথমে চোখে পড়বে শান-বাঁধানো একটি পুকুর এবং বন বিভাগের রেস্টহাউস। এই পুকুরটিই চরের সীমিত সংখ্যক অস্থায়ী বাসিন্দাদের, মূলত বনরক্ষীদের, মিঠাপানির একমাত্র উৎস। চরের পূর্ব দিকে রয়েছে একটি ছোট সমুদ্র সৈকত, যেখানে ভাটার সময় নিশ্চিন্তে সমুদ্রস্নান উপভোগ করতে পারবেন।
---কখন যাবেন ফাতরার চর?
ফাতরার চর ভ্রমণের জন্য নভেম্বর থেকে মার্চ মাস সবচেয়ে আদর্শ। এই সময়টায় আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক থাকে এবং পর্যটকদের জন্য ২ ঘণ্টার জন্য চরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য শীতকালই সেরা সময়।
---কিভাবে পৌঁছাবেন ফাতরার চরে?
ফাতরার চর দেখতে হলে প্রথমে আপনাকে কুয়াকাটা পৌঁছাতে হবে। কুয়াকাটা থেকে ফাতরার চরের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন বেশ কিছু ট্রলার চলাচল করে।
কুয়াকাটা থেকে ফাতরার চর ভ্রমণ:
- ট্রলারের আনন্দ: কুয়াকাটা থেকে জনপ্রতি ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা ভাড়ায় (ভাড়া সিজনের ওপর নির্ভর করে) ট্রলারে ফাতরার চরে যাওয়া যায়। চাইলে ট্রলার রিজার্ভ করেও ব্যক্তিগতভাবে এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। প্রায় ২ ঘণ্টায় আপনি প্রকৃতির এই লুকানো রাজ্যে পৌঁছে যাবেন।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটা:
ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার জন্য সড়ক ও নদী উভয় পথই বেছে নিতে পারেন।
১. নদী পথে (লঞ্চে):
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে ঢাকার সদরঘাট থেকে সরাসরি কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে ভালো সার্ভিসের লঞ্চ চলাচল কিছুটা কমেছে। তাই ভ্রমণের আগে লঞ্চের সময়সূচী এবং প্রাপ্যতা জেনে নেওয়া ভালো।
- ঢাকা সদরঘাট থেকে পটুয়াখালী: প্রতিদিন সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে পটুয়াখালীগামী লঞ্চ ছেড়ে যায় এবং সকাল ৭টার দিকে পটুয়াখালী পৌঁছায়।
- ভাড়া: ডেক ৪০০-৫০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ১৩০০ টাকা, ডাবল কেবিন ২৪০০ টাকা, ভিআইপি কেবিন ৭০০০ টাকা।
- পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা: পটুয়াখালী লঞ্চ ঘাট থেকে অটোতে বাস স্ট্যান্ড গিয়ে লোকাল বাসে কুয়াকাটা যেতে হবে। এতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগবে এবং ভাড়া ১৫০-১৬০ টাকা।
- ঢাকা সদরঘাট থেকে বরিশাল: সদরঘাট থেকে সন্ধ্যার পর বরিশালের উদ্দেশ্যে একাধিক লঞ্চ ছেড়ে ভোরে বরিশাল পৌঁছায়।
- বরিশাল থেকে কুয়াকাটা: বরিশাল লঞ্চঘাট থেকে রূপাতলি বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে কুয়াকাটা যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। যেতে প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লাগবে এবং বাস ভাড়া ১৮০-২৫০ টাকা।
২. সড়ক পথে (বাসে):
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে কুয়াকাটার দূরত্ব প্রায় ২৯৪ কিলোমিটার। বাসে যেতে প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগে।
- বাস সেবা: ঢাকার সায়েদাবাদ, আব্দুল্লাহপুর, আরামবাগ অথবা গাবতলী বাস স্ট্যান্ড থেকে সাকুরা পরিবহন, শ্যামলী, গ্রিনলাইন, ইউরো কোচ, হানিফ, টি আর ট্রাভেলস সহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস সরাসরি কুয়াকাটা যায়।
- ভাড়া: নন-এসি বাসের ভাড়া ৭৫০-৯০০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১১০০-১৬০০ টাকা।
কোথায় থাকবেন?
ফাতরার চরে কোনো স্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা নেই, তবে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে রেস্টহাউসে রাত্রিযাপন করতে পারেন। যদি ফাতরার চরে রাত কাটানোর পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে কুয়াকাটায় বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল আপনার জন্য আদর্শ।
- কুয়াকাটার হোটেল: কুয়াকাটায় ৪০০ টাকা থেকে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের হোটেল রয়েছে। শেয়ার করে থাকলে খরচ কম হবে। সিজন এবং সরকারি ছুটির দিন ছাড়া গেলে আগে থেকে হোটেল বুক করার প্রয়োজন হয় না। তবে, অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন!
খাবারের সংস্থান
ফাতরার চরে একটি মাত্র দোকান রয়েছে যেখানে মোটা চালের ভাত আর মুরগির মাংস ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তাই ফাতরার চরে যাওয়ার সময় সাথে হালকা খাবার নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। কুয়াকাটায় অবশ্য নানা ধরনের খাবারের দোকান ও রেস্টুরেন্ট পাবেন, যেখানে আপনার রুচি অনুযায়ী খাবার উপভোগ করতে পারবেন।
ভ্রমণ টিপস: ফাতরার চর সংরক্ষিত বনাঞ্চল হওয়ায় এখানে প্রবেশের জন্য বন বিভাগের অনুমতি প্রয়োজন হয়। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে বনের ভেতরে কোনো আবর্জনা ফেলবেন না এবং বন্যপ্রাণীদের বিরক্ত করবেন না।
Comments
Post a Comment